
স্যাটেলাইট (Satellite) হলো মহাকাশে পৃথিবীর চারপাশে বা অন্য কোনো গ্রহের কক্ষপথে থাকা একটি যন্ত্র বা বস্তু, যা বৈজ্ঞানিক, সামরিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
স্যাটেলাইটগুলো সাধারণত দুটি প্রকারে বিভক্ত: প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম। প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট হলো যেমন চাঁদ, যা পৃথিবীর মতো গ্রহের চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে আবর্তিত হয়। অন্যদিকে, কৃত্রিম স্যাটেলাইট হলো মানব নির্মিত ডিভাইস, যা মহাকাশে প্রেরণ করা হয় নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য। এখন আমরা স্যাটেলাইট কী, এর কার্যকারিতা, প্রকারভেদ এবং এর বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
★স্যাটেলাইটের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ:-
স্যাটেলাইট শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ “স্যাটেলাইটেস” থেকে, যার অর্থ হলো সহকারী বা অনুগামী। এটি এমন একটি যন্ত্র যা অন্য কোনো বস্তুর কক্ষপথে আবর্তিত হয়। স্যাটেলাইট সাধারণত দুটি প্রধান প্রকারের হয়:
1. **প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট**: এটি কোনো প্রাকৃতিক বস্তু যা কোনো গ্রহের কক্ষপথে থাকে, যেমন চাঁদ পৃথিবীর প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট।
2. **কৃত্রিম স্যাটেলাইট**: এটি মানবসৃষ্ট যন্ত্র যা মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। কৃত্রিম স্যাটেলাইট বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন যোগাযোগ, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, সামরিক নজরদারি, এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
★ কৃত্রিম স্যাটেলাইটের ইতিহাস:-
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর, সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইট **স্পুটনিক-১** মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। এই সাফল্যের মাধ্যমে শুরু হয় স্যাটেলাইটের যুগ, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে ওঠে। স্পুটনিক-১ ছিল একটি ছোট স্যাটেলাইট যার ভর ছিল মাত্র ৮৩.৬ কেজি, এবং এটি পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করত। এর মাধ্যমে রেডিও সংকেত পাঠানো সম্ভব হতো, যা সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন দেশ মহাকাশ গবেষণা এবং স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে প্রতিযোগিতায় নামে।
★ কৃত্রিম স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ:-
কৃত্রিম স্যাটেলাইটগুলো বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এগুলোর বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে:
1. **যোগাযোগ স্যাটেলাইট**: এই স্যাটেলাইটগুলো যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ব্যবহৃত হয়। টেলিভিশন সম্প্রচার, ফোন সংযোগ এবং ইন্টারনেট সার্ভিসের জন্য যোগাযোগ স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। এগুলো সাধারণত ভূস্থির কক্ষপথে থাকে, যা পৃথিবীর নির্দিষ্ট একটি স্থানকে সব সময় কাভার করে।
2. **আবহাওয়া স্যাটেলাইট**: এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর আবহাওয়া এবং জলবায়ু পর্যবেক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলো আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঝড়-ঝাপটা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে এবং তথ্য সংগ্রহ করে। যেমন, **NOAA** এবং **Meteosat** হলো এমন কিছু আবহাওয়া স্যাটেলাইট যা আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য ব্যবহৃত হয়।
3. **ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট**: এই স্যাটেলাইটগুলো জিপিএস এবং অন্যান্য ন্যাভিগেশন সিস্টেমের জন্য ব্যবহৃত হয়। ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন যানবাহন ও ডিভাইসের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, **GPS**, **Galileo**, এবং **GLONASS** সিস্টেমগুলো ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইটের উপর নির্ভরশীল।
4. **গবেষণা স্যাটেলাইট**: বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর বাইরের মহাকাশ, সৌরজগত, গ্রহ, এবং মহাজাগতিক রশ্মি ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। **হাবল স্পেস টেলিস্কোপ** হলো একটি বিখ্যাত গবেষণা স্যাটেলাইট যা মহাকাশের গভীরে অবস্থিত বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে।
5. **সামরিক স্যাটেলাইট**: সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলো গোয়েন্দাগিরি, যোগাযোগ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম। যেমন, **Keyhole** এবং **Lacrosse** হলো কিছু সামরিক স্যাটেলাইট যা বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে।
★ স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে?
স্যাটেলাইট সাধারণত একটি রকেট বা উৎক্ষেপণ যান (launch vehicle) এর মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানো হয়। উৎক্ষেপণের পর স্যাটেলাইটটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপিত হয়, যা পৃথিবীর কক্ষপথের নির্দিষ্ট উচ্চতায় থেকে নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে। কক্ষপথে থাকা অবস্থায় স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে এবং এর মাধ্যমে পৃথিবীতে থাকা স্টেশনগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে।
স্যাটেলাইটগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা সাধারণত **মাইক্রোওয়েভ** এবং **রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি** প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। স্যাটেলাইটে থাকা সেন্সর ও অন্যান্য ডিভাইস বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠায়। স্যাটেলাইটগুলো নিজেদের শক্তির জন্য সাধারণত সোলার প্যানেল ব্যবহার করে, যা সূর্যের আলোক রশ্মি থেকে শক্তি সংগ্রহ করে।
★ স্যাটেলাইটের উপকারিতা;-
স্যাটেলাইট মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। এর কিছু প্রধান উপকারিতা হলো:
1. **যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন**: স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট ইত্যাদি সেবা সরবরাহে স্যাটেলাইটের অবদান অপরিসীম।
2. **আবহাওয়া পূর্বাভাস**: আবহাওয়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আবহাওয়ার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা যায়, যা ঝড়-ঝাপটা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক।
3. **ন্যাভিগেশন ও ট্র্যাকিং সিস্টেম**: জিপিএস সিস্টেমের মাধ্যমে আজকের বিশ্বে ন্যাভিগেশন এবং ট্র্যাকিং সহজতর হয়েছে, যা ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
4. **গবেষণা ও মহাকাশ অন্বেষণ**: গবেষণা স্যাটেলাইটগুলো মহাকাশ এবং পৃথিবীর বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে, যা মহাকাশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সহায়ক।
★ স্যাটেলাইটের চ্যালেঞ্জ:-
যদিও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি অত্যন্ত উন্নত, তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। স্যাটেলাইট তৈরি এবং উৎক্ষেপণ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এছাড়া, স্যাটেলাইটের কক্ষপথে থাকাকালীন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয় না, তবে একসময় এর কার্যকারিতা হারায়, যা “স্পেস ডেব্রিস” বা মহাকাশের আবর্জনার সৃষ্টি করে। এই আবর্জনা মহাকাশে পরবর্তী স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগে মাঝে মাঝে আবহাওয়া এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
স্যাটেলাইট প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এক অসাধারণ আবিষ্কার যা যোগাযোগ, গবেষণা, ন্যাভিগেশন এবং সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে মানুষের জীবন অনেক বেশি সহজ ও উন্নত হয়েছে। কিন্তু, স্যাটেলাইট পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা সঠিকভাবে মোকাবেলা করলে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত এবং কার্যকর হতে পারে।