
সম্পাদকীয়।।
শনিবার (১৩ জুলাই) রাত দশটার দিকে জান্নাতুল ফেরদৌসী সুমাইয়া (১৯) নামে এক তরুণী আত্মহত্যা করে। ঘটনাটি শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীর রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের বিশগিরি গ্রামের। দুঃখজনক হলেও আমাদের পরিচিত সমাজে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ।
তবে সুমাইয়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। যার পেছনের গল্প সিনেমার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। সুমাইয়ারা ভালবাসার রঙ্গিন একটি সংসার পাততে চায়। সব মেয়েই চায় বিয়ে করে স্বামী সন্তান নিয়ে নিজেরা একটি আলাদা সংসার তৈরি করতে। ভালবেসে বিয়ে করেছিল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মাহুতি দিয়ে তার মূল্য চুকাতে হল। মৃত্যুর আগে সুমাইয়া লিখে ৭ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে গেছে। তাতে তার বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, অপমান আর না পাওয়ার বেদনাগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। সুমাইয়া লিখেছে, “অনেক ইচ্ছা ছিল বউ সাজব, আমাদের সন্তান হবে, আমাকে মা ডাকবে, তা আর হলোনা”।
আমাদের চারপাশে নানাভাবে ফাঁদ পেতে বসে আছে কিছু মুখোশধারী দুর্বৃত্ত ও প্রতারক। এমনি এক প্রতারকের ফাঁদে পড়ে সুমাইয়া। অতঃপর বিয়ে করে স্বামীর পরিবারের সদস্যদের প্রতারণা আর নির্যাতনের শিকার হয় সে। সুমাইয়া বুঝতে পারে, এদের পুরো পরিবারটিই প্রতারক এবং লোভী। শেষ পর্যন্ত বড় অংকের যৌতুকের চাপে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সুমাইয়া আত্মহত্যা করে বিরূপ সমাজ সংসার থাকে মুক্তি নিয়েছে। কিন্তু আমাদের সামনে রেখে গেছে একটি বার্তা, ” আমি ভালবেসেছিলাম, বিনিময়ে ভালবাসা পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই সমাজটা আমার জন্য নয়। আমি একটি সুস্থ সমাজ পাইনি।”
“অর মা আর বোনের জন্য কোন মেয়ে অদের বাড়িতে থাকতে পারবেনা।”
আত্মহত্যার আগের সেই চিঠিতে সুমাইয়া লিখে গেছে, “বিয়ের গোসলটাও পেলাম না। শেষ গোসলটাও পাব না। জানাযাও পাব না। আমার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। অনেক ভালোবাসি তোমাকে শিপন। কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে থাকতে দিলা না।” সুমাইয়ার এই আকুতি কি শিপন বা তার পরিবারকে শোধরাতে সাহায্য করবে? আসলে এরা শোধরায় না, অন্যের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গোছানোর কাজটা এরা পরিকল্পিতভাবেই চালিয়ে যায়। সুমাইয়া সেটা বুঝতে পেরেছিল বলেই লিখে গেছে, “অর মা আর বোনের জন্য কোন মেয়ে অদের বাড়িতে থাকতে পারবেনা।”
সুমাইয়াদের পরিবারটি ছিল মোটামুটি সাজানো গোছানো। মা মাহমুদা বেগম ছিলেন রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচিত ইউপি সদস্য। পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা সুমাইয়া। বরুয়াজানি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করত সে।
এরই মধ্যে এক সেনা সদস্যের সাথে সুমাইয়ার বিয়ের কথাবার্তা হয়। তবে ওই সেনা সদস্যের পরিবার মেয়ের নামে জমি লিখে নিতে চাইলে সেই বিয়ে ভেঙে যায়। এতে সুমাইয়ার জেদ চেপে বসে কোন সেনা সদস্যের সাথেই ঘর বাঁধবে সে।
ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে সেনা সদস্যের মিথ্যা পরিচয়ে সুমাইয়ার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে শিপন নামের এক প্রতারক। শিপন শেরপুর সদর উপজেলার সাপমারী গ্রামের হযরত আলীর ছেলে এবং পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী শ্রমিক। শিপনের বড়ভাই সেনা সদস্য। সেই বড়ভাই এর সামরিক বাহিনীর পোশাক পরে ছবি উঠিয়ে ফেসবুক প্রোফাইলে তা আপলোড করে। এমনকি ফেসবুকে নিজেকে সেনাসদস্য বলে পরিচয় দেয় সে। শিপন-সুমাইয়ার সম্পর্কের শুরু এখান থেকেই।
একপর্যায়ে শেরপুর জেলা শহরে এসে দেখা করে তারা। গত ৮ মাস আগে কৌশলে সুমাইয়াকে গোপনে দেড় লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করে শিপন। এর কদিন পর বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। সুমাইয়ার পরিবারের চাপের মুখে চার লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে পুনরায় বিবাহ রেজিস্ট্রির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অতি চতুর শিপন প্রতারণা করে আবারো দেড় লাখ টাকা দেনমোহরেই বিয়ে রেজিস্ট্রি করে।
বিয়ের পরপরই সুমাইয়ার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার কালো অধ্যায়। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের প্রতারণার ফাঁদে আটকাতে থাকেন সুমাইয়া। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই শিপনের সেনা সদস্য বড় ভাই সুমাইকে দিয়ে ব্র্যাক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ তুলে নেয়। একইভাবে সুমাইকে দিয়ে আরো দু’দফায় দুটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ তুলে নের শিপনের মেঝো ভাই। আর শিপন নিজেও তাকে দিয়ে তুলে নেয় ৩০ হাজার টাকা ঋণ সুমাইয়াকে এভাবেই জড়িয়ে ফেলা হয় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার ঋণের ফাঁদে।
এবার শুরু করা হয় নতুন খেলা। বলা হয় শিপনের জন্য চাকুরী ঠিক হয়ে গেছে। তবে এজন্য অনেকগুলো টাকা লাগবে। সুমাইয়াকে চাপ দেয়া হয় তার বাবার পরিবার থেকে ৮ লাখ টাকা এনে দিতে। এর এক পর্যায়ে শিপনের বাবা ও বোন সুমাইয়াকে শারীরিক নির্যাতনও করে। এবিষয়ে সুমাইয়া নিজেই তার চিঠিতে লিখে গেছে।
“অর পরিবারের লোকজন আমাদের দুজনকে একসাথে থাকতে দিলনা।”
এক পর্যায়ে গেল ঈদুল ফিতরের আগে সুমাইয়াকে তার পরিবারের লোকজন বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর শিপন মাঝেমধ্যে শশুড়ালয়ে যাতায়াত করতে থাকে। কিন্তু সুমাইয়া বুঝতে পারে যে, সে একটি প্রতারক পরিবারের জালে শক্তভাবে আটকে গেছে। তাদের কাছে ভালবাসার কোন মূল্য নেই। সুমাইয়া লিখে গেছেন “অর পরিবারের লোকজন আমাদের দুজনকে একসাথে থাকতে দিলনা।” অবশেষে চরম হতাশায় নিজের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে মুক্তি নেয় সে। নির্মম এই পরিস্থিতিতে বাকরুদ্ধ সুমাইয়ার স্বজনসহ এলাকাবাসী।
সুমাইয়া তার চিঠিতে আরো লিখে যায়, “তোমাকে অনেক ভালোবাসি শিপন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে দিলানা তোমার সাথে। আমি চাইলে দ্বিতীয় বিয়ে করে জীবনটা ভালোভাবে চালাতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই না দ্বিতীয় কেউ আমার শরীরটা উপভোগ করুক”। এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সুমাইয়া শিপনকে কতটা ভালবাসত। কিন্তু শিপনের সাথে সংসার করতে সবরকম চেষ্টা করেও সে পেরে উঠেনি ।
সুমাইয়ার চিঠিতে লিখা একটি বাক্য রয়েছে আমাদের সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে। সে লিখেছে “টাকা দিয়ে হয়ত আইন কিনে দিতে পারবে কিন্তু আল্লাহকে কিনতে পারেন না”। ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি পত্রিকার খবরে লিখা হয়েছে ‘পরিবারের অমতে বিয়ে করার শিপনের পরিবার বিয়েটা মেনে নেয়নি। ফলে তারা আলাদাভাবে বসবাস করতো। একথা যদি সত্যি হয় তবে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা তার নামে ঋণ উঠিয়ে নিল কিভাবে? বাস্তবতার সাথে খবরটির কোন মিল নেই। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে খবরটিতে হয়ত সচেতনভাবেই সুমাইয়ার মৃত্যুর দায় থেকে শিপনের পরিবারকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমরা এই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে সেই দায় নিতে চাইনা। সুমাইয়াকে যারা এই পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা হোক। অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়।
সবশেষে বলতে চাই, প্রত্যেকের জীবনেই বহুবার কঠিন সময় আসে। কিন্তু জীবন থেকে সরে যাওয়া কোন সমাধান নয়। এসব পরিস্থিতিতে আবেগকে কর্মের উপরে স্থান দিলেই হেরে যাবেন। আজকের দিনটা কেবল আজকের মতোই। আগামী কারণটা হয়তো আপনার জন্য শুভ বার্তা নিয়ে আসবে। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করুন। স্রষ্টা আপনার উপর কিছু দায়িত্ব দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।