নিজস্ব প্রতিবেদক :
শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক মাদক পাচারকারী চক্র। প্রতিদিন ভারত থেকে পাচার হয়ে আসছে মাদকের চালান। এসব মধ্যে রয়েছে মদ,গাঁজা হিরোইন, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক।
মাদক পাচারকারী চক্রের সদস্যরা সীমান্ত পথে ভারত থেকে নামি দামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাদক পাচার করে এনে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাচার করে আসছে। পাশাপাশি জেলার সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মাদকের সরবরাহ ও ব্যবহার। ফলে জেলা শহরসহ গ্রামগঞ্জে সর্বত্রই হাত বাড়ালেই মিলছে মদ, গাঁজা, হিরোইন, ফেন্সিডিল ও ইয়াবা। আর এর প্রভাবে তরুণ ও যুব সমাজ বেপরোয়াভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
মাঝে মধ্যেই র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এমনকি সাধারণ জনতার হাতেও মাদক আটকের ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে সীমান্ত এলাকাগুলোতে মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যরা সক্রিয় হওয়ায় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি সদস্যদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের মধ্যে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়তা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে একাধিক মাদক ব্যবসায়ী চক্র। জেলার ভারত সীমান্তের ৪০ কিলোমিটার সীমান্তবর্তী এলাকার দুর্গম পাহাড়ি পথে নালিতাবাড়ি উপজেলার সমশ্চুড়া, নাকুগাঁও, কালাপানি, বুরুঙ্গা, বারোমারি, হাতিপাগাড়, চৌকিদারটিলা, ঝিনাইগাতী উপজেলার হলদিগ্রাম, সন্ধ্যাকুড়া, রাংটিয়া, গোমড়া, নকশী, গজনী, তাওয়াকোচা ও শ্রীবরদী উপজেলার খাড়ামুড়া, কর্ণঝোড়া এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে আসছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য।
বিষয়ে জানতে চাইলে বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অতীতের ন্যায় পদচারণা না থাকায় সীমান্ত এলাকায় দিনে রাতে অপরিচিত মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়।’
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সীমান্ত পথে গভীর রাত পর্যন্ত অপরিচিত প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের রহস্যজনক আনাগোনা। সীমান্তের সড়ক ও সংলগ্ন রাস্তা উন্নয়ন হওয়ায় মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, সিএনজি ও ইজিবাইক এমনকি দূরপাল্লার বাসে ও বালুর ট্রাকে করে রাতের আঁধারে মাদকের চালান দেশের বিভিন্ন স্থানে অনায়াসে পাচার করে আসছে। এছাড়া মাদক পাচারকারীরা মাদক পাচারে ব্যবহার করে আসছে কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের। স্কুল ব্যাগে করে মাদক পাচারে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে জেলা সদরসহ গ্রামেগঞ্জে হাটে বাজারে, পাড়া মহল্লায় ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে কিশোর গ্যাং এর পদচারণা এবং বেপরোয়া মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য।
আরো জানা যায়, মাদকের ছড়াছড়ি ও সহজ লভ্যতার কারণে অতি সহজেই মাদক পৌঁছে যাচ্ছে কিশোরদের হাতে। এতে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন বাড়ছে। জানা যায়, গত ২৯ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে স্কুলব্যাগে করে ১৯ বোতল ভারতীয় মদ পাচারকালে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের সিএনজি স্টেশন থেকে রাকিবুল ইসলাম(১৩) নামে এক কিশোরকে আটক করে স্থানীয় জনতা। একই রাতে ডাকাবর এলাকা থেকে ১১৯ বোতল ভারতীয় মদসহ ৩ জনকে আটক করে থানা পুলিশ।
২৩ অক্টোবর বুধবার রাত ১১টার দিকে উপজেলা সদরের ব্যাগে মাদক নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে ‘সিয়াম বাস কাউন্টারে’ বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে আটক হয় ৩ মাদক পাচারকারী। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ২৪ বোতল ভারতীয় মদসহ উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের রাংটিয়া গ্রামের কালুগাজির ছেলে মিস্টার আলী (২৯), বাচ্চু মিয়ার ছেলে বাদল মিয়া (২০) ও চান মিয়ার ছেলে আয়নাল হক ( ২৫) কে গ্রেফতার করে।
হলদিগ্রাম সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে ৩টি অভিযানে ভারতীয় ২০০ বোতলেরও বেশি মদ ও কম্বলসহ ২ জনকে আটক করে হলদিগ্রাম সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবি সদস্যরা।
নালিতাবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, গত ৬ নভেম্বর রাতে দাওধারা এলাকা হতে প্রাইভেটকারে করে পাঁচারকালে ৭৭৪ বোতল ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদসহ ২ চোরাকারবারিকে আটক করে নালিতাবাড়ী থানা পুলিশ।এরপর বারোমারি এলাকা থেকে ৩৬ বোতল ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ডিবি পুলিশের পৃথক অভিযানে ১৩ কেজি গাঁজা, ৩৭০ পিছ ইয়াবা, বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল ও ৫০ বোতল ভারতীয় মদ উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শেরপুর ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৬ নভেম্বর রাতে নালিতাবাড়ী উপজেলার বারোমারি এলাকা থেকে ৫০ বোতল ভারতীয় মদসহ ও ফেনসিডিলসহ ৩ জনকে আটক করে ডিবি পুলিশ।
শেরপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ফয়সাল মাহমুদ জানান, গত এক বছরে ৬৮৫ টি মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছেন তারা। এসব অভিযানে ২৮৬ জনকে গ্রেপ্তারসহ নিয়মিত ২৮টি ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২৫৯ টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল আমিন বলেন, গত মাসে ৫ টি মাদকবিরোধী অভিযানে ২ শতাধিক বোতল ভারতীয় মদসহ ৮ জনকে আটক করেছে ঝিনাইগাতী থানা পুলিশ। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জেলার পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলামের সাথে মাদক পাচার সম্পর্কে কথা হলে তিনি বলেন, এলাকার যে কোন স্থানে মাদক পাচারের ঘটনার সন্ধান পেলে আমাকে জানাবেন। মাদক নির্মূলে আমরাও যথারীতি চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত।