দৈনিক শেরপুর রিপোর্ট :
আজ রোববার (২৪ নভেম্বর) শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড় অধ্যুষিত মরিয়মনগরে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে গারোদের ওয়ানগালা (নবান্ন উৎসব)। মরিয়মনগর ধর্মপল্লিতে এ বছর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওয়ানগালা উৎসব ছিল এটি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ ধর্ম প্রদেশের বিশপ পনেন পল কুবি। অনুষ্ঠান শেষে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা পরিচালনা করেন তিনি।
উল্লেখ্য, হাজার হাজার বছর ধরে শেরপুরে আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। ১২৫৭ থেকে ১৪৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শেরপুর অঞ্চলের শাসক ছিলেন তারা। আধিপত্য হারানোর সাথে এখনকার গারো সম্প্রদায় তাদের সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টির অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে। তবে জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় ও সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী গারো সম্প্রদায় প্রতি বছর ফসল ঘরে উঠানোর পর তাদের ঐতিহ্যবাহী ওয়ানগালা উৎসব এখনও পালন করে আসছেন। এবছরও শেরপুরের সীমান্তবর্তী মরিয়মনগর ধর্মপল্লীতে ওয়ানগালা উৎসবে নেচে-গেয়ে মেতে ওঠেন তারা। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খৃষ্টভক্ত এই ওয়ানগালা উৎসবে অংশ গ্রহণ করেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারোদের নিজস্ব ভাষায় গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়। দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে র্যাফেল ড্র ও বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
ওয়ানগালা উৎসব তাদের জীবন-জীবিকা, ঐতিহ্য, কৃষ্টি সবকিছুকেই প্রভাবিত করে। ওয়ানগালা উৎসবে মূলত ফসল আহরণের পর শস্য দেবতাকেই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করা হয়। ওয়ানগালা না হওয়া পর্যন্ত নতুন উৎপাদিত ফসলাদি তারা নিজেরা খায় না।
একসময় গারো পাহাড় এলাকায় জুম চাষ হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিশি সালজং’কে উৎসর্গ করে এই উৎসবের আয়োজন করা হতো। পৌরাণিক কাল থেকেই গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছিল। এখনকার গারো সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ক্যাথলিক খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত। ফলে তাদের ধর্মীয় সংস্কারও বদলে গেছে কিন্তু এখনো তারা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্র হয়ে ওয়ানগালা উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে।
এখন নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিষ্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন তারা। শেরপুরের সীমান্তবর্তী আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর মনে করে ঈশ্বরের দয়ায় তারা ফসল উৎপাদন করে থাকে। তাই তারা প্রতি বছর ঈশ্বরকে ফসল উৎসর্গ করে থাকে ওয়ানগালা উৎসবের মাধ্যমে।
মূলত থক্কা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু করা হয় এ উৎসব। এরপর প্রার্থনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ গান ও খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা ও র্যাফেল ড্রসহ উৎসবে মেতে ওঠে নৃ-গোষ্ঠীর নারী, পুরুষ ও শিশুরা। এখানে অনেকেই তাদের ফসলের কিছু অংশ প্রভুর নামে উৎসর্গ করেন, আবার কেউ প্রভুর কাছে দয়া প্রার্থনা করেন।
শিক্ষার্থী সুইট চিচিং বলেন, ‘ঈশ্বর আমাদের নতুন ফসল দেয়। এ উৎসবে আমরা নতুন ফসল প্রভুর কাছে উৎসর্গ করি, নাচ-গানের মধ্য দিয়ে আনন্দ করি। আমাদেরকে প্রভু আশীর্বাদ করবেন, পরের বছরও আমরা ভালো ফসল পাব। প্রভু আমাদের পরিবারের জন্য দয়া করে থাকেন। উৎসবে আমরা নতুন কাপড় পরি। অনেক বন্ধু-বান্ধব একসাথে হতে পারি। বাড়িতে বাড়িতে অতিথিরা আসে। আমরা খুব আনন্দ পাই।’
সমিকা ম্রং বলেন, ‘আমরা আসলে নতুন ফসল প্রভুকে উৎসর্গ করার জন্যই এই উৎসব পালন করে থাকি। নতুন ফসল প্রভুকে আগে উৎসর্গ করে তারপর নিজেরা খাই। এইটা নবান্ন উৎসবের মতো হলেও আমরা এইটাকে ওয়ানগালা হিসেবে পালন করি। এ উৎসবের মাধ্যমে খ্রিস্টকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।’
ময়মনসিংহ ধর্ম প্রদেশের বিসপ পনেন পল কুবি বলেন, ‘আমাদের মান্দি সমাজে আদি পিতামাতা যারা ছিলেন তারা সাংসারিক ধর্ম পালন করতেন। তারা আনন্দে ওয়ানগালা উৎসব পালন করতেন। এ ওয়ানগালা হলো জমির নতুন ফসল ঈশ্বরকে দেওয়া বা কৃতজ্ঞতা জানানো। এই দিবসে আমরা খ্রিষ্ট রাজাকে সম্মান ও বিশ্বাস প্রদর্শন করে থাকি। আমরা যখন এই উৎসব পালন করি তখন চিন্তা করি কীভাবে আমরা আগামী বছর যিশুকে সাথে নিয়ে পথ চলতে পারি।’