মো. নমশের আলম :
কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধ শেরপুর জেলা দেশের অন্যতম খাদ্য উদ্বৃত্ত একটি জেলা।শেরপুর থেকে সরা বছর বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হয়। একসময় সরিষা উৎপাদনেও সমৃদ্ধ ছিল শেরপুর।নানা কারণে সরিষা চাষ কমে গেলেও গত ৫ বছরে আবারও সরিষার আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।
কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যমতে এ বছর সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে। এই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৬৮ হেক্টর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলতি মৌসুমে সরিষার উৎপাদন ২৬ হাজার টন ছাড়িয়ে যেতে পারে যা শেরপুর জেলার সারা বছরের মোট ভোজ্যতেলের চাহিদার চেয়েও বেশি।
জেলার অন্যতম সরিষা চাষের এলাকা হিসেবে পরিচিত নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা এলাকা। এখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল জুড়ে যেদিকেই তাকানো যায় কেবল চোখে পড়ে সরিষা ক্ষেতের হলুদের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ ফসলি জমি ছেয়ে গেছে সরিষার হলুদ ফুলের চাদরে। সমস্ত প্রকৃতি যেন হলুদ রঙে সেজেছে। হলুদের সমারোহে প্রকৃতির এই মোহনীয় রূপ দেখে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। চারদিকে ছড়িয়েছে পড়েছে সরিষা ফুলের মৌ মৌ সুবাস। ফুলে ফুলে গুনগুন করছে মৌমাছি। ভ্রাম্যমাণ মৌচাষিরা পাশেই মৌচাক বসিয়ে মধু আহরণ করছে।
সরিষা আবাদ করে কৃষকরা কি ফলাফল পাচ্ছেন তাই জানতে কথা হয় স্থানীয় চন্দ্রকোনা বাজার এলাকা ও বাছুর আলগা এলাকার কৃষক সরিষা চাষি মো. মোজাফফর মিয়া, মো. মোস্তফা কামাল, মো. দুদু মিয়া সহ আরো কয়েকজনের সাথে। তারা বলেন সেই বৃষ্টিশ শাসনামল থেকেই চন্দ্রকোনা এলাকাটি সরিষা চাষের জন্য বিখ্যাত এলাকা। লাভক্ষতির হিসাব মিলাতে গিয়ে মাঝে কয়েক বছর সরিষা চাষ কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন উন্নত জাতের সরিষা চাষে ফলন বেড়েছে। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার ফলে সরিষার দামও বেড়েছে। তাই সরিষা চাষে লাভ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ বছর হতে সরিষার আবাদ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরিষার চাষ করে তাঁদের সংসারেও ফিরেছে স্বাচ্ছন্দ্য।
কৃষকরা আরও জানান, আমন ধান কেটে সেই জমিতে এবং বর্ষার পানি চলে যাওয়ার পর সেই জমিতে বোরো ধান চাষের আগে অল্প সময়ে কম পরিশ্রমেই একটি বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা চাষ করা যায়। সরিষা চাষে রোগবালাই তেমন নেই বললেই চলে। তাই পরিচর্যাও তেমন করতে হয় না। তাছাড়াও সরিষার আবাদ করলে সেই জমিতে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং সেই ক্ষেতে বোরো ধান চাষ করতে সার কম লাগে। কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার পেয়েছেন তাদের কেউ কেউ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা।
জেলা খামারবাড়ি সূত্র জানায়, দেশে আমদানি নির্ভর ভোজ্য তেলের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকায় সরকারি উদ্যোগে গত কয়েক বছর রেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসল নিবিড়িকরণ প্রকল্পের আওতায় শেরপুর জেলায় তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এর আওতায় সরিষার আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষক পর্যায়ে প্রণোদনা প্রদান, প্রদর্শনী মাঠ বৃদ্ধি ও কৃষক সমাবেশ করা হচ্ছে। বিনা চাষে সরিষা চাষের বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। ফলে গত ৫ বছরে শেরপুর জেলায় সরিষার আবাদ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সরিষা ক্ষেতের নিবিড় পরিচর্যায় চাষিদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। ফলে জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪ গুণ। জেলায় এ বছর সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৭২০ হেক্টর। এই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৬৮ হেক্টর জমিতে যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩২০ হেক্টর বেশি। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এ বছর সরিষার উৎপাদন ২৬ হাজার টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সচেতন মহল বলছেন, তেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে সরকারি সহায়তায় কৃষি বিভাগের মাধ্যমে সরিষার চাষ বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সরিষা চাষে কৃষকের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে। এতে কৃষকরা যেমন লাভবান হবেন তেমনি ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।