ছবি সংগৃহীত: টাঙ্গাইলের মোগল স্থাপত্য সলিমাবাদ তেবাড়িয়া জামে মসজিদ
মোঃ নমশের আলম : সাংবাদিক, কবি, কলামিস্ট
টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের তেবাড়িয়া গ্রামে অবস্থিত ‘সলিমাবাদ তেবাড়িয়া জামে মসজিদ’ একটি মোঘল স্থাপত্য সমৃদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনা। মসজিদটি বর্তমানে ওয়াকফ বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ৪০০ শত বছর আগে স্থাপিত এই ধর্মীয় স্থাপত্যকে ঘিরে অনেক জনশ্রুতি আছে।
মসজিদে দান করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। জ্বীন’রা নিরব রাতের অন্ধকারে এ মসজিদে নামাজ পড়তে আসে। সংলগ্ন পুকুরে গিয়ে চাইলেই ভেসে ওঠে পিতলের থালা-বাসন। এমন সব প্রচলিত জনশ্রুক্তি শোনা যায় লোকের মুখে মুখে। প্রচলিত জনশ্রুক্তি বলছি এজন্য যে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মসজিদ এবং মাজারকে জড়িয়ে আছে এমন নানা লৌকিক বিশ্বাস। এসবের কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা প্রমাণ নেই। আধুনিক সমাজ সভ্যতায় এসব লৌকিক বিশ্বাস নিয়ে মতভেদ থাকলেও একেবারে অস্বীকার করে না। ফলে লৌকিক বিশ্বাস থেকে আলোচনা হতে হতে একসময় তা মানুষের মধ্যে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। স্থানীয়দের দাবি যমুনা নদীর ভাঙ্গনে পুরো এলাকা বিলীন হলেও অক্ষত রয়েছে এই অলৌকিক মসজিদ।
নদীর প্রখর স্রোত আর ঢেউয়ের প্রাবল্যে মসজিদটি দোলতে থাকে কিন্তুু ভেঙে পড়ে না। মসজিদটিকে ঘিরে এসব রহস্যের কারণে এলাকার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে এই মসজিদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মহাত্ন এখনও প্রবল।
স্থানীয় সূত্রে এবং উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী এই পল্লী অঞ্চলে প্রমত্তা যমুনা নদীর কোলঘেষে তেবাড়িয়া জামে মসজিদটি ১৬০১ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত হয়েছে। দুই একর তেপান্ন শতাংশ ভূমি নিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই মসজিদ স্থাপনা করেন এখানকার মৃধা বংশোদ্ভূত আব্দুল মালেক খাঁ মৃধা। মসজিদ নির্মাণ শেষে আব্দুল মালেক খাঁ মৃধা মিম্বারে দাড়িয়ে উপস্তিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে অছিয়ত করে বলেন, তাঁর মৃত্যু যে স্থানে হবে সেই স্থানেই যেন তাকে কবরস্থ করা হয়। একথা বলে মিম্বার থেকে নেমে যাওয়ার পর-পরই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীকালে মুসুল্লি সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যায়ক্রমে সন্মুখ ভাগে দুইটি ছাদ নির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে মসজিদটিতে প্রায় ২,২০০ জন মুসল্লী এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ নির্মাণের পর থেকে মৃধা বংশোদ্ভূত সদস্যরাই এটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। বর্তমানে মুতাওয়াল্লীর দায়িত্তে আছেন মৃধা বংশোদ্ভূত বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. হাফিজ খান তালুকদার এবং সভাপতি হিসেবে আছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. আতিকুর রহমান তালুকদার।
মসজিদটির নির্মাণকাল থেকেই এর একটি দৃষ্টি নন্দন বড় গম্বুজ এবং চার পাশে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১২ টি মিনার রয়েছে। নদী থেকে উচু স্থানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়ে ছিলো বলে সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হতো। উত্তর-দক্ষিন দিকে রয়েছে দুইটি দৃষ্টি নন্দন ঘর। এখানে বিশ্বাসী জনসাধারণ দাঁড়িয়ে মানত করেন হাঁস-মুরগী এবং গরু-ছাগল থেকে শুরু করে নগদ টাকা ও স্বর্ণ।
জানা যায়, সেকালে মূল ভবনের পাশে একটি বিশাল আকারের জাম গাছ ছিলো। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পণ্যবাহী নৌযান সেই গাছের সাথে বেঁধে রাখা হতো।
পরবর্তী সময়ে মৃধা বংশোদ্ভূত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. আতিকুর রহমান তালুকদার মসজিদের পশ্চিম পাশে ৩৭ শতাংশ ভূমি, মরহুম মোহাম্মদ আতোয়ার খান ১০ শতাংশ মরহুম আকাজত খা’র ৬ কন্যাগন ৬ বিঘা ভুমি মসজিদের নামে দান করেন। এছাড়াও আরও দেড় বিঘা জমি দান করেন মুসলেম তালুকদার, যা বিগত কয়েক বছর আগে যমুনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এসকল জমির উৎপাদিত ফসল বিক্রির অর্জিত অর্থ কোষাগারে জমা করা হয়।
কথিত আছে, তৎকালীন সময়ে মসজিদের ভিতরে একজন নেককার পরহেজগার ব্যক্তি অবস্থান করতেন। উনাকে সবাই পাগল ভাবলেও প্রকৃতপক্ষে উনি একজন আল্লাহর ওলি ছিলেন। মসজিদটি যখন প্রবাহমান যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হতে যাছিল তখন ওই ব্যক্তি মসজিদের পশ্চিম দিকে নদীর পানির উপর দিয়ে হেটে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যান। পরবর্তীতে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনার পর থেকে যমুনা নদীর গতিপথ মসজিদ থেকে পশ্চিম দিকে অনেক দূর সরে যায়। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া পূর্বের মিনারটি বর্তমানে মসজিদের উত্তর-পশ্চিম পাশে প্রায় ১০০ ফিট উঁচু করে পূনঃনির্মান করা হয়।